আপনি তুমি রইলে দূরে
নির্মেঘ আকাশ ঝলমল করে রোদে। ঘরের মধ্যে লুটোয় বাতাস ও রোদ। বাতাস আর রোদের আদরে সে একটু একটু বড় হয় ভাড়াবাড়ির দোতলায়। সকালবেলা বাবা অফিসে যায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে আসে। বাবা ফিরে এ‡j যেন একরাশ আনন্দ ফিরে আসে। মেয়েটি তখন হামলে পড়ে বাবার কোলে। বাবা-মেয়ের কাণ্ড দেখে মা হাসে। মায়ের মনেও আনন্দ হয়।
তখন সে সবে চার। এক-দুপা করে মেয়েটি জীবনের দিকে এগিয়ে যায়। সকালে বাবা অফিস চলে গেলে মা মেয়েকে নিয়ে খেলে। খেলে, রান্না করে, গান শোনে। গানের সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে দিয়ে মা ছাদে যায় কাপড় শুকোতে। মেয়েটি বড় হতে থাকে। খুব দ্রুতই বড় হয়। আর তখন ঠাকুর-মশায় মার সুরের ভেতর দিয়ে জন্ম নিতে থাকেন মেয়েটির বুকের গভীরে। তখন ধীরে ধীরে মার বুকেও জন্ম নিতে থাকে ক্ষত। সে ক্ষত কতটা গভীর তা বোঝার মত বয়স তার তখনও নয়। ধীরে ধীরে বাবা দূরে সরে যেতে থাকে মার কাছে থেকে। মেয়েটির কাছ থেকেও।
মেয়েটি বুঝতে পারে আকাশে মেঘ জমছে। বাতাস দমকা হচ্ছে। দমকা বাতাস ঝড়ো হচ্ছে। মা আর মেয়েটি ছিটকে পড়ছে ইঞ্জিনিয়ার বাবার জীবন থেকে। ছিটকে গিয়ে তারা তখন গ্রামে। নানাবাড়িতে। সমবেদনার প্রথম আবেগ মুছে গিয়ে ধীরে মার জীবনে যুক্ত হয় অবহেলা। মেয়েটির জীবনেও। সব বুঝতে শুরু করে মেয়েটি। বুঝতে শেখে তার বাবা নেই। তার বাবা তখন অন্যকেউ হয়ে গেছে। তার বাবা হয়তো তখনও ফিরে আসছে অফিস থেকে। কিন্তু তার জন্য আনন্দ হয়ে বাবা আর ফিরে আসে না।
তখন মা হন্যে হয়ে ফিরছে একটা চাকরির জন্য। সেই অস্থির অবহেলার জীবনে আবার রবীন্দ্রনাথ ফিরে ফিরে আসছেন মার কাছে। মেয়েটির কাছেও। ঠাকুর ফিরে আসছেন বিপুল স্বস্তি হয়ে। ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা, এসো হে গোপনে, আমার স্বপনলোকের দিশাহারা। ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন… আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা। যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে, নিয়ো গো, নিয়ো গো, আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে। একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরে রূপে, দিয়ো গো, দিয়ো গো, আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া। সারাদিনের ছুটোছুটি ফিরে মা ঠাকুরের গানে প্রাণ পেতে দিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে কাঁদছেন। মা-র কান্নায় হুহু করে জল আসছে মেয়েটির চোখে। মেয়েটি কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটিও গলা মিলিয়ে দেয়, একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরে রূপে, দিয়ো গো, দিয়ো গো, আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়ায়। পুরনো সেই রেকর্ড প্লেয়ারে কিশোর কুমারের ভরাট গলায় যখন বেজে উঠছে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ তখন ভেঙে পড়া মাকে চনমনে লাগে মেয়ের কাছে। মায়ের মুখের স্মিত হাসিটি মেয়েকে আশ্বস্ত করে। আসলে স্বয়ং ঠাকুর এসে যেন হাত রাখেন মেয়েটির মাথায়। সুরের ঐকতানে মেয়েটির প্রাণের ভেতর স্পর্শ করেন গভীর মমতা হয়ে। গল্প শুনতে শুনতে মেয়েটি বড় হচ্ছে। অ-তে অজগর, অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আম, আমটি আমি খাব পেড়ে আওড়াতে আওড়াতে মায়ের কাছে ‘কাবুলিওয়ালা’ পড়ে। নিজেকে মিনি ভেবে মেয়েটি কতদিন কাবুলিওয়ালার অপেক্ষায় থেকেছে। কাবুলিওয়ালা কি তার বাবা! অথচ যখন কেউ জিজেস করে, বাবার কাছে যাবে? মেয়েটি যেন মিনি হয়ে বলে, ‘হামি বাবাকে মারবে। তখন মা কি কষ্ট পেত মেয়ের কথা শুনে। তখন মা কি হারিয়ে যেত ফেলে আসা দিনগুলোতে। মা তখন গান শোনে, ‘যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর, আর পারি নে রাত জাগতে হে নাথ, ভারতে অনিবার।’ ওদিকে মেয়েটি তখন ডুব দিচ্ছে গল্পগুচ্ছে।
হৈমন্তি তাকে কাঁদাচ্ছে, নিরুপমা তাকে কাঁদাচ্ছে, রতন তাকে কাঁদাচ্ছে, ফটিক তাকে কাঁদাচ্ছে। তারাপদ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে ওখানে, মৃন্ময়ীর সঙ্গে সে একটা দস্যি মেয়ে হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, সুশীলচন্দ্রের বাবা সুবলচন্দ্রের শাসনের কথা জেনে তার মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার কথা। কোথায় বাবা! কোথায় কে জানে!
বাবাকে অন্যের বাবা হতে দিয়ে মেয়েটি বড় হচ্ছে। স্কুলে যাচ্ছে। ছুটির দিনে গান গাইছে। মার রেকর্ড প্লেয়ারে শোনা গান, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। আহা, হাহা, হা। কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই, কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা। কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে- তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে। রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু, মাখর গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হাহা, হা।’ কিন্তু মেয়েটি গায়ে ফুলের রেণু মাখতে পারছে না। একদিন মা বরং রঙিন শাড়ি পরে বসে যাচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। বসে ঠিক যাচ্ছে না, বসতে বাধ্য হচ্ছে। একটা মেয়েকে নিয়ে একজন নারী গলগ্রহ হয়ে উঠেছে। নিজের পরিবার ও সমাজের কাছে গলগ্রহ হয়ে ওঠা সেই নারী, যে একদিন ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ বলতে যাকে বুঝেছে, তখনও তাকেই। অথচ তাকেই এমন এক সম্পর্কে জড়াতে হচ্ছে যা কোনোদিন সে চায়নি।
আর মেয়েটি ভেসে যাচ্ছে অন্তহীন জলে। নিঃসীম শূন্যতার মধ্যে হাহাকার করে বাজছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কী করবে মেয়েটি। যেদিক দুচোখ যায় চলে যাবে! গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে যাবে ফ্যানে! বেদনার ক্যাথারসিসে আটকে গেছে মেয়েটির জীবন। তখন সান্ত্বনা হয়ে তাকে আবারও কাছে ডাকছেন ঠাকুর-মশায়, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো, সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।…বাসনা যখন বিপুল ধূলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়, ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।’ মেয়েটি তাই ডুবতে ডুবতে ডোবে না। হাহাকারের মধ্যে ভেসে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে আলোর মধ্যে। সাহিত্য পড়তে এসে আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাথ পড়ছে। পরীক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ পড়তে ভাল লাগেনি। আনন্দের জন্য রবীন্দ্রনাথ পড়ে মেয়েটি কাঁদছে। দিনে দিনে, অলস দুপুরে, মনখারাপ করা গোধূলিতে, সবুজ চায়ের কাপে, সকালের নাশতায় মেয়েটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখছেন রবীন্দ্রনাথ। বুকের মধ্যে শক্তি হয়ে মেয়েটির হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, বিষম ঝড়ের বায়ে, আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে, মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়, আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়। দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি, আমার দুঃখ দিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে।’