3rdcahpter

বক্তৃতা

সম্মানিত সুধী
দক্ষিণ বাংলার প্রাণকেন্দ্র বিভাগীয় শহর খুলনায়, পাবনা সমিতির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আজকের এ অভিষেক-আয়োজনে, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত প্রধান অতিথি,(জনাব…) বিশেষ অতিথি,(জনাব…), খুলনাস্থ পাবনা সমিতির সকল সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষী এবং মঞ্চের সামনে উপবিষ্ট আমাদের সবার প্রিয় পাবনা জেলার ভাই ও বোনেরা, আস সালামু অলাইকুম।
আজ আমি খুবই আনন্দিত।
আজ থেকে অনেক বছর আগে, যখন নিজের জেলার পরিচিত মানুষ, পরিচিত পরিবেশ থেকে এই অনাত্মীয়, নির্বান্ধব শহরে এসেছিলাম, কিছুই ভালো লাগত না—না এখানকার মানুষ, না এখানকার আবহাওয়া। একজন পরিচিত মানুষের দেখা পাওয়ার জন্য কী-না করেছি। দিনের পর দিন কেটে গেছে, কোনো চেনামুখের দেখা পাইনি। কাজের সূত্রে যাদের সঙ্গে মিশেছি, কথা বলেছি, কীসের যেন একটা অভাব বোধ করেছি। প্রথম প্রথম আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারিনি, আমার বুকের ভেতর এত শূন্যতা কেন! এমন হাহাকার লাগে কেন! পরে বুঝেছি, জন্মভূমির ভাষায় কথা না বলতে পেরে আমার বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা হয়ে থাকতো। কাউকে বলতে পারিনি, ভাইস্তে, চলেক, চাস্টলে যায়া চা খায়া আসি।
আজ এই অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের এলাকার ভাষায় কথা বলার জন্য অনেক ভাইবোনকে একসঙ্গে পেয়েছি। এই বক্তৃতাটা আনুষ্ঠানিক বলে প্রমিত বাংলাতেই বলতে হচ্ছে। না-হলে, পাবনার ভাষায় কথা বলার যে আনন্দ, তা আর কোথায় পাবো! কীসে পাবো! বাংলা সাহিত্যের আঠারো শতকের একজন কবি, তাঁর নাম রামনিধি গুপ্ত, তখনকার মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ডাকতো নিধু বাবু বলে। নিজের ভাষা নিয়ে এই কবি ছোট একটা কবিতা লিখেছিলেন, ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা পুরে কি আশা! কবিতাটা ছোট, কিন্তু অন্তর্গত ভাবটা খুবই গভীর। নিজের অঞ্চলের ভাষা ছাড়া আসলেই আশা মেটে না। এখন এ শহরে আমরা কেউই আর অনাত্মীয় নই, নির্বান্ধব নই। নিজেদের ভাষায় কথা বলার জন্য এখন আর আমাদের লোকেরও অভাব হয় না। পাবনা সমিতি আমাদের এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সবচেয়ে সুখের কথা হলো এই, পাবনা সমিতির প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার কিঞ্চিৎ অবদান আছে।
তাই, আজ আমি খুবই খুশি, খুবই আনন্দিত।

 

উপস্থিত পাবনাবাসী ও অন্যান্য অভ্যাগত অতিথিবৃন্দ
আমি আর কথা বাড়াবো না। আমি কথা বেশি বলতেও পারি না। ভাষার কথা বলছিলাম। একটু পরিবেশের কথাও বলতে চাই। জন্মের পর থেকে যে প্রাকৃতিক আবহে আমরা বড় হয়েছি, এখানে এসে বুঝি, তা কী অসাধারণ! সমুদ্রের কাছাকাছি খুলনা শহরের লবণাক্ত আবহাওয়ায় এসে প্রতি মুহূর্তে আমাদের মনে পড়ে, প্রমত্তা পদ্মার কথা, স্রোতস্বিনী যমুনার কথা। মনে পড়ে পাবনা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল চলনবিলের কথা, সমুদ্রের মতো দিগন্তহীন গাজনার বিলের কথা। নদী আর বিলের শান্ত জলের ভেতর থেকে উঠে আসা বাতাস গায়ে মেখে বড় হওয়া আমরা সমুদ্রের লবণাক্ততা নিতে পারি না।
একটাই দেশ আমাদের। অথচ কত বৈচিত্র্য। খুলনা থেকে পাবনা এমন কোনো দূরও নয়। তবু পরিবেশে, প্রতিবেশে কত পার্থক্য।
কিন্তু আমাদের একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পাবনা সমিতি সবার আগে দেশের কথাই বেশি করে ভাবার জন্যই গঠিত হয়েছিল। মাত্র ৬৪টি জেলা মিলে একটি দেশ। জেলারও আছে উপজেলা, উপজেলারও ইউনিয়ন, গ্রাম, বাড়ি, পরিবার। কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজন। আমরা এই পাবনা সমিতি করেছিলাম কোনো বিভাজনের জন্য নয়। বরং এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র একককে একসঙ্গে করে মূলত দেশের জন্য নিজেদের সদিচ্ছা বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলাম। দেশকে ভালোবাসার শপথ নিতে চেয়েছিলাম।
সুপ্রিয় অতিথি ও অন্যরা
আঞ্চলিক সমিতি করে আমরা যেন বৈষম্যমূলক আচরণ না করে ফেলি। এই খুলনা শহর আমাদের ভালোবেসে স্থান দিয়েছে। আমাদের রুটিরুজির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। খুলনাকে আমরা ভালোবাসি। খুলনাকে আমাদের ভালোবাসতে হবে। খুলনা আমাদেরও শহর। মনে রাখবেন, আমরা যেন নিজেদের কাছে নিজেদের ছোট করে না ফেলি। সবাইকে ভালোবাসতে পারলেই আমরা যেমন মানুষ হিসেবে শ্রেয়তর হবো, এর ফলে, আমাদের আচরণে, কাজে, ভালোবাসায় আমাদের জেলার সুনাম হবে, সম্মান বাড়বে দেশে এবং বিদেশে।
পাবনা সমিতি গঠন করার সময় আমরা এই কথা ভেবেছিলাম। নিজেদের ভেতর সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলে পুরো দেশের সামনে আমাদের প্রিয় পাবনা জেলাকে মডেল হিসেবে দেখানোর একটা স্বপ্ন মনের মধ্যে অবশ্যই ছিল।
আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে দেখে, সকলের ঐক্য ও সহমর্মিতা দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সেই স্বপ্ন ব্যর্থ হয়নি।
সকলকে আবারও আমার প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা ও শুভকামনা জানিয়ে আমার বক্তৃতা শেষ করছি। সকলের কল্যাণ হোক।
আস সালামু অলাইকুম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *